**ইসলামে কৃতজ্ঞতার গুরুত্ব: শুকরিয়া আদায়ের শক্তি ও প্রভাব**
**আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আল্লাহ আমাদের যে অগণিত নিয়ামত দান করেছেন, তার জন্য আমরা কতটুকু কৃতজ্ঞ? কৃতজ্ঞতা শুধু একটি ভালো গুণ নয়, এটি ঈমানেরও অপরিহার্য অংশ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের জীবন, স্বাস্থ্য, সম্পদ, পরিবার এবং আরও অনেক কিছুর মাধ্যমে তাঁর নিয়ামত বর্ষণ করেছেন। কিন্তু আমরা কি সত্যিই এসব নিয়ামতের মূল্যায়ন করি? কুরআন আমাদের শেখায় যে, অধিকাংশ মানুষ নিয়ামত পেলেও শুকরিয়া আদায় করে না। বরং তারা ভুলে যায়, অবহেলা করে, এবং নিজেদের প্রাপ্য হিসেবেই সবকিছু গ্রহণ করে। কিন্তু যখন সামান্য বিপদ আসে, তখন তারা অভিযোগ করতে শুরু করে।**
**কুরআনে শুকরের গুরুত্ব**
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কৃতজ্ঞতাকে ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন:
**”إِن تَشْكُرُوا يَزِدْكُمْ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ”**
➡️ **”যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তবে আমি তোমাদের আরও দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে অবশ্যই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন।” (সূরা ইবরাহীম: ৭)*
এখানে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে, কৃতজ্ঞ বান্দাদের তিনি আরও অনুগ্রহ দান করেন, কিন্তু যারা অকৃতজ্ঞ, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।
আল্লাহ আরও বলেন:
“وَقَلِيلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ”**
➡️ **”আমার বান্দাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ।”** *(সূরা সাবা: ১৩)*
এ থেকে বোঝা যায়, সত্যিকারের কৃতজ্ঞ হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটি একটি বিরল গুণ।
**মানুষের প্রবৃত্তি ও শুকরের অভাব**
মানুষের স্বভাবই হলো, কল্যাণের সময় আল্লাহকে ভুলে যাওয়া। আমরা যখন সুস্থ, সম্পদশালী ও নিরাপদে থাকি, তখন আল্লাহর নিয়ামতের কথা মনে রাখি না। কিন্তু যখনই কোনো বিপদ আসে, তখনই আমরা আল্লাহর দিকে ফিরে যাই। এটি আমাদের প্রবৃত্তির একটি বড় দুর্বলতা।
**আল্লাহ বলেন:**
**”وَإِذَا أَنْعَمْنَا عَلَى الْإِنسَانِ أَعْرَضَ وَنَأَىٰ بِجَانِبِهِ وَإِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ كَانَ يَئُوسًا”**
➡️ **”আমরা যখন মানুষকে নিয়ামত দিই, তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও দূরে সরে যায়। আর যখন তার উপর কোনো বিপদ আপতিত হয়, তখন সে হতাশ হয়ে পড়ে।”** *(সূরা বনী ইসরাইল: ৮৩)*
এটি আমাদের সকলের জন্য একটি শিক্ষা যে, আমরা যেন শুধু বিপদের সময় আল্লাহকে ডাকি না, বরং সুখে-দুঃখে সবসময়ই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি।
—
### **কৃতজ্ঞতার বাস্তব উপায়**
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য আমাদের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে চলা উচিত:
1️⃣ **হৃদয়ের অনুভূতি:** আমরা আমাদের অন্তরে অনুভব করব যে, সব কিছু আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে এবং আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।
2️⃣ **জিহ্বার স্বীকৃতি:** আল্লাহর নিয়ামতের জন্য সর্বদা “আলহামদুলিল্লাহ” বলা উচিত।
3️⃣ **ইবাদতের মাধ্যমে শুকর:** নামাজ, সিয়াম এবং অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
4️⃣ **সদকাহ ও দান-খয়রাত:** আল্লাহর দেওয়া সম্পদ ও ক্ষমতাকে অন্যের কল্যাণে ব্যয় করা।
5️⃣ **নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকা:** আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতকে তাঁর অবাধ্যতায় ব্যবহার না করা।
—
### **সুলাইমান (আ.) ও কারুনের শিক্ষা**
সুলাইমান (আ.) তাঁর রাজত্বের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন:
**”هَذَا مِن فَضْلِ رَبِّي لِيَبْلُوَنِي أَأَشْكُرُ أَمْ أَكْفُرُ”**
➡️ **”এটি আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন – আমি কৃতজ্ঞ থাকি না অকৃতজ্ঞ হই।”** *(সূরা নামল: ৪০)*
অন্যদিকে, ধনী কারুন বলেছিল:
**”إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَىٰ عِلْمٍ عِندِي”**
➡️ **”আমার এই ধনসম্পদ আমার জ্ঞান ও দক্ষতার কারণে অর্জিত হয়েছে।”** *(সূরা কাসাস: ৭৮)*
কারুনের অহংকারের কারণে আল্লাহ তাকে সম্পদসহ ভূগর্ভে নিমজ্জিত করেন, কিন্তু সুলাইমান (আ.) আরও বেশি বরকত পান কারণ তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছিলেন।
—
### **শুকরের ফলাফল**
যদি আমরা কৃতজ্ঞ হই, তবে আমাদের জীবনে শান্তি ও বরকত আসবে। আমরা দুঃখ-কষ্টের পরিবর্তে ভালো দিকগুলো দেখব এবং অন্তরে প্রশান্তি পাব।
**আল্লাহ বলেন:**
**”وَمَن شَكَرَ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ”**
➡️ **”যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে আসলে নিজেরই উপকার করে। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, আল্লাহ তো অভাবমুক্ত, প্রশংসার যোগ্য।”** *(সূরা লুকমান: ১২)*
উপসংহার
শুকর শুধু একটি গুণ নয়, বরং এটি ঈমানের অপরিহার্য অংশ। একজন সত্যিকারের মুমিন সবসময় আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতকে স্বীকৃতি দেয়, তাঁর প্রশংসা করে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ পালন করে।
আসুন, আজ থেকেই আমরা ছোট ছোট নিয়ামতের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় শুরু করি। মনে রাখবেন, কৃতজ্ঞতা শুধু আল্লাহকে খুশি করে না, এটি আমাদের জীবনকেও সুন্দর ও বরকতময় করে তোলে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কৃতজ্ঞ বান্দা হিসেবে কবুল করুন। আমিন!