
আয়াতুল কুরসি হলো সূরা আল-বাকারা (২:২৫৫)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত, যা কুরআনের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ও শক্তিশালী আয়াত হিসেবে পরিচিত। যদিও এটি একটি মাত্র আয়াত, তবে এতে নয়টি বাক্য রয়েছে, যা একে অনন্য করে তুলেছে। আয়াতুল কুরসির একটি বিস্ময়কর গঠনশৈলী রয়েছে, যা আরবি ভাষার “চিয়াসটিক স্ট্রাকচার” (Chiasmus) নামে পরিচিত। এটি এমন একটি গঠন যেখানে আয়াতের প্রথম বাক্যের এবং শেষ বাক্যের মধ্যে একটি সাদৃশ্য/সামঞ্জস্য (symmetry) থাকে, এমনিভাবে দ্বিতীয় বাক্যের এবং শেষের আগের বাক্যের মিল থাকে, এবং এই ধারা মধ্যম বাক্য (কেন্দ্রবিন্দু) পর্যন্ত চলতে থাকে।
এই কাঠামোটি বিশ্লেষণ করে দেখি:
১ম ও শেষ (৯ম) অংশের সাদৃশ্য:
প্রথম বাক্য : اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ
“আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, পরম রক্ষণাবেক্ষণকারী।”
শেষ বাক্য : وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ
“তিনি সর্বোচ্চ, পরম মহান।”
প্রথম আয়াতে আল্লাহর তাঁর চিরঞ্জীব (الْحَيُّ) ও পরম রক্ষণাবেক্ষণকারী (الْقَيُّومُ) হওয়ার কথা বলা হয়েছে, আর শেষ আয়াতে বলা হয়েছে যে তিনি সর্বোচ্চ (الْعَلِيُّ) এবং মহান (الْعَظِيمُ)। এটি আল্লাহর গুণাবলির মধ্যে সরাসরি মিল তৈরি করে এবং নির্দেশ করে যে এই আয়াতের বিন্যাস কেবল ভাষাগতভাবে নয়, বরং কাঠামোগতভাবেও নিখুঁত।
২য় ও ৮ম অংশের সাদৃশ্য:
দ্বিতীয় বাক্য : لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ
“তাঁকে তন্দ্রা স্পর্শ করে না এবং না করে নিদ্রা।”
অষ্টম বাক্য : وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا
“এই দুটিকে রক্ষা করা তাঁকে ক্লান্ত করে না।”
দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, আল্লাহ কখনো তন্দ্রাচ্ছন্ন হন না বা ঘুমান না, আর অষ্টম বাক্যে বলা হয়েছে যে আসমান ও জমিনের রক্ষণাবেক্ষণও তাঁকে ক্লান্ত করে না। এটি আল্লাহর পরিপূর্ণ শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ বোঝায়।
৩য় ও ৭ম অংশের সাদৃশ্য:
তৃতীয় বাক্য : لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ
“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তাঁর।”
সপ্তম বাক্য : وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ
“তাঁর কুরসি (সিংহাসন) আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী পর্যন্ত বিস্তৃত।”
তৃতীয় বাক্যে বলা হয়েছে যে আল্লাহ আসমান ও জমিনের সমস্ত কিছুর মালিক, আর সপ্তম বাক্যে বলা হয়েছে যে তাঁর আরশ আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে, যা বোঝায় যে তিনি একই সাথে আসমান ও জমিনের মালিক ও রাজা।
৪র্থ ও ৬ষ্ঠ অংশের সাদৃশ্য:
চতুর্থ বাক্য : مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ
“কে আছে, যে তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করতে পারে?”
ষষ্ঠ বাক্য : وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ
“তাঁর জ্ঞান থেকে তারা কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না, তবে যা তিনি ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত।”
চতুর্থ অংশে বলা হয়েছে, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ সুপারিশ করতে পারবে না, আর ষষ্ঠ অংশে বলা হয়েছে, কেউ তাঁর জ্ঞান আয়ত্ত করতে পারে না যদি না তিনি অনুমতি দেন। উভয় অংশেই আল্লাহর অনুমতির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং সৃষ্টির সীমাবদ্ধতা এবং আল্লাহর পূর্ণ কর্তৃত্ব বোঝায়।
মধ্যবর্তী (৫ম) অংশ:
পঞ্চম বাক্য : يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ
“তিনি জানেন যা তাদের সামনে এবং যা তাদের পেছনে।”
এই আয়াতের কেন্দ্রবিন্দু হলো “আল্লাহর অসীম জ্ঞান, অতীত বা ভবিষ্যতের কিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়।”। বাকিরা তাঁর জ্ঞান সীমিতভাবে পায়, কিন্তু তিনি সবকিছু জানেন।
সারসংক্ষেপ
কুরআন মৌখিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, তবুও এতে অসাধারণ গাণিতিক সামঞ্জস্য ও নিখুঁত কাঠামো রয়েছে। কুরআনের ভাষাশৈলী অত্যন্ত চমৎকার ও অলৌকিক, যা প্রমাণ করে যে এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত।
আয়াতুল কুরসি শুধু একটি আয়াত নয়, বরং একটি শক্তিশালী বার্তা, যা আমাদের ঈমানকে মজবুত করে এবং আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও দয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।